সব কিছুতেই প্রথম হওয়ার একটা গৌরব আছে।ইংরেজিতে এদেরকে বলে ট্রেইলব্লেজারস অথবা পাইওনিয়ার। বাংলায় অগ্রদূত।পৃথিবীতে আছে কোটি কোটি মানুষ, হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান, সভা সংঘ। এদের সবাইকে হটিয়ে কোনো স্থানে সবার আগে পৌঁছে যাওয়ার মধ্যে এক ধরনের আত্মশাঘা, অহঙ্কার আর গর্বের অনুভূতি কাজ করে। চিন্তা করুন ১৮৭৬ সালের ১০ মার্চের সেই মুহূর্তটির কথা, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল নামে এক যুবক যখন টেলিফোনে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করেছিলেন: মি. ওয়াটসন, এখানে আসুন, আমি আপনাকে দেখতে চাই। এ কথাগুলো কেবল টেলিফোনে বলা মামুলী কিছু কথা ছিল না, এগুলো ছিল ইতিহাস, কারণ এটাই ছিল টেলিফোন ব্যবহার করে বলা বিশ্বের প্রথম মানব বাণী! একইভাবে ইন্টারনেট তথা তথ্যপ্রযুক্তির কথা চিন্তা করুন। আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রথম ভালবাসার নাম ইন্টারনেট। দুনিয়াদারী ভুলে নেটেই পড়ে থাকেন এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়। এরা নেটিজেন। নেট যুগের নাগরিক। কিন্তু নেট তথা ইন্টারনেট আজকের এই জায়গায় এক দিনে পৌঁছায়নি। সময় লেগেছে অনেক। তার সঙ্গে লেগেছে বহু মানুষের বহু দিনের পরিশ্রম। আর এভাবেই আজ কয়েক দশকের মাথায় ইন্টারনেট এবং তার অসংখ্য পরিষেবা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জীবনের এবং হৃদয়ের এত কাছের। আর এজন্য আমরা সবাই কৃতজ্ঞ ইন্টারনেট দুনিয়ার সব ট্রেইলব্লেজারস আর পাইওনিয়ারদের প্রতি। একটা কিছু আবিষ্কার করা হয়ে গেলে সেটি ব্যবহার করা বা সেটির আদ্যোপান্ত জানা খুব সহজ। কিন্তু প্রথম যার বা যাদের মাধমে এ ব্যাপারটা ঘটল তাদের জন্য এসব এতটা সহজ ছিল না। এ কারণেই প্রথম ওয়েব সাইটটি যিনি ডিজাইন করেছিলেন অথবা প্রথম ইমেইলটি যিনি পাঠিয়েছিলেন তিনি সব সময়ই আমাদের কাছে শ্রদ্ধা ও সমীহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবেন। এ জায়গা থেকে তাঁকে বা তাঁদেরকে কেউ নড়াতে পারবে না। আজকের প্রযুক্তি পাঠশালায় আমরা ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব-এর ভুবন থেকে হাজির করেছি এরকমই কিছু প্রথম, তথা অগ্রদূতকে।
প্রথম ইমেইল১৯৭১। বিশ্বের ইতিহাসে সারা জীবনই অন্তত আমাদের বাঙালী জাতির কাছে এ বছরটি অম্লান হয়ে থাকবে আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা স্বাধীনতার অর্জনের বছর হিসেবে। মজার ব্যাপার হল, ইন্টারনেটের ভুবনেও ১৯৭১ একটি মনে রাখার মত বছর, কারণ এ বছরই রে টমলিনসন নামে এক প্রযুক্তি পাগল মানুষ পাঠিয়েছিলেন ইতিহাসের প্রথম ইমেইলটি।কেবল বিশ্বের সর্বপ্রথম ইমেইল প্রেরক হিসেবেই নয়, ইমেইল ঠিকানায় ব্যবহারকারীর নামকে কম্পিউটারের নাম থেকে আলাদা করার জন্য বহুল পরিচিত @ চিহ্নটি প্রবর্তনের কৃতিত্ব্ও টমলিনসনের। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকেই কম্পিউটার থেকে কম্পিউটারে বার্তা পাঠানোর বিভিন্ন পদ্ধতি চালু ছিল বটে, তবে এগুলো ছিল একই ধরনের মেইনফ্রেম মেশিনে বিভিন্ন ব্যবহারকারীর একজন থেকে আরেকজনের কাছে পাঠানো বার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।টমলিনসনের কৃতিত্ব হচ্ছে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইমেইলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো এবং ইমেইলকে সেই রূপ দেয়া যে রূপে আজ আমরা এটিকে চিনি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, রে টমলিনসন যখন ইমেইল বার্তার জন্ম দেন তখনও ইন্টারনেটে জিনিসটারই জন্ম হয়নি, তবে জন্ম হয়েছিল এর পূর্বসুরীর, যার নাম ছিল চাইতে বেশি।
সর্বপ্রথম ডোমেইন নাম
ইন্টারনেটে বিশ্বের সর্বপ্রথম যে ডোমেইন নামটি রেজিস্ট্রি করা হয় তার নাম সিম্বলিক্স.কম (SYMBOLICS.COM)। এটি রেজিস্ট্রি করা হয় ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ তারিখে।এ ডোমেইন নামটির মালিক ছিল ‘সিম্বলিক্স’ নামে একটি কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এটি আজ আর নেই, তবে এখনও টিকে আছে সিম্বলিক্স.কম নামে সেই ওয়েব সাইটটি।
সর্বপ্রথম স্প্যাম ইমেইলস্প্যাম ছাড়া আজকের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তথা ইন্টারনেটের ভুবনের কথা কল্পনাও করা যায় না। অবাঞ্চিত, অনাকাক্ষিত এসব মেইল অপ্রয়োজনে ভর্তি করে আমাদের ইনবক্স, ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি করে ইন্টারনেটের ইনফরমেশন সুপার হাইওয়েতে। যাই হোক, বিশ্বের সর্বপ্রথম স্প্যাম মেসেজ পাঠানো হয় একই সঙ্গে আরপানেটের ৩৯৩ জন ব্যবহারকারীর কাছে। তারিখটি ছিল ১৯৭৮ সালের ৩ মে। স্প্যাম মেইলটি পাটিয়েছিলেন গ্যারি থুয়ের্ক (Gary Thuerk) নামে এক ব্যক্তি। এ মেইলে ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট কর্পোরেশন (ডিইসি) কোম্পানির তৈরি নতুন মডেলে একটি ডিজিটাল কম্পিউটারের ব্যাপক গুণগান করা হয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ব্যাপারটা তিনি উপভোগ করুন বা নাই করুন, এই গ্যারি থুয়ের্কই হচ্ছেন ইমেইল স্প্যামের জনক। এ কীর্তি থুয়ের্ককে তুলে দিয়েছে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এর পাতাতেও! অবশ্য সেই ১৯৭৮ সালে স্প্যাম কথাটিই জন্ম নেয়নি। এটির জন্ম আরো অনেক অনেক পর।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধাসম্বলিত সর্বপ্রথম মোবাইল ফোন
ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধাসহ সর্বপ্রথম যে মোবাইল ফোনটির কথা জানা যাচ্ছে সেটি হচ্ছে নকিয়ার ৯০০০ কমিউনিকেটর (Nokia 9000 Communicator)। সেই ১৯৯৬ সালে ফিনল্যান্ডে লঞ্চ করা হয়েছিল এ ফোন। তবে সেবাদাতা সংস্থা ইন্টারনেট সেবার জন্য যে দাম হেঁকেছিল সেটাই সাধারণ ব্যবহারকারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছিল এ ফোনকে। ১৯৯৯ সালে জাপানের এনটিটি ডকোমো আই-মোড নামে একটি ফোন লঞ্চ করে জাপানে।মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে অন্যতম সেরা পাইওনিয়ার বলে মনে করা হয় এ ফোনটিকেই।
সর্বপ্রথম ওয়েব সাইটবিশ্বের সর্বপ্রথম ওয়েব সাইটটির ঠিকানা ছিল info.cern.ch এবং সুইজারল্যান্ডের পার্টিকেল ফিজিক্স রিসার্চ সেন্টার সার্ন (CERN)-এ রক্ষিত একটি NeXT কম্পিউটারে ছিল এর অবস্থান।বিশ্বের সর্বপ্রথম ওয়েব পেজটির ঠিকানা:http://info.cern.ch/hypertext/WWW/TheProject.html। এতে রক্ষিত ছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব প্রজেক্ট সম্পর্কিত নানা তথ্য। ঐ পেজটা এখন আর নেই, তবে এ পেজটির পরবর্তীকালের একটি কপি (১৯৯২ সালের) এখন রক্ষিত আছে W3C সংগঠনের ওয়েব সাইটে। ঠিকানা: www.w3.org/History/19921103-hypertext/hypertext/WWW/TheProject.html ।
সর্বপ্রথম ই-কমার্স সাইট স্টিং-এর ‘টেন সামনারস টেলস’ সিডি-র কাভারযদিও ই কমার্সের ভুবনে বিশ্বজোড়া নাম কেনার ক্ষেত্রে ই-বে এবং আমাজন-এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, এরা কিন্তু বিশ্বের সর্বপ্রথম ই-কমার্স সাইট ছিল না।নেটমার্কেট নামে অনলাইনে খুচরা পণ্য বিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যই বরাদ্দ আছে সে সম্মান। তারাই বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিরাপদে খুচরা বিক্রয় ও অর্থ লেনদেনের রেকর্ড গড়ে। ১৯৯৪ সালের ১১ আগস্ট এ সাইটটি স্টিং-এর ‘টেন সামনারস টেলস’সিডি-র একটি কপি বিক্রি করে ১২ ডলার ৪৮ সেন্টে। হ্যাঁ, পাঠানোর খরচ বা শিপিং কস্টসহ। অবশ্য কেউ কেউ বলেন ‘ইন্টারনেট শপিং নেটওয়ার্ক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানই সর্বপ্রথম অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের কাজটি সম্পন্ন করে। ইন্টারনেট শপিং নেটওয়ার্ক দাবি করে, তারা নেটমার্কেটের ঝাড়া এক মাস আগেই অনলাইনে পণ্য বিক্রয় করেছিল।
সর্বপ্রথম অনলাইন ব্যাংকসর্বপ্রথম যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে তাদের সব গ্রাহক ও সেবাগ্রহীতার জন্য ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা প্রদান শুরু করেছিল সেটির নাম ‘স্ট্যানফোর্ড ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়ন’।যুক্তরাষ্ট্রের এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে এ সেবা প্রদান শুরু করেছিল।
সর্বপ্রথম সার্চ ইঞ্জিনএমনকি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জন্মেরও আগে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনের প্রচলন ছিল। তবে এদের কাজ ছিল খুবই সীমিত, এবং কেবলমাত্র ওয়েব পেজের টাইটেলই সার্চ করতে পারত তারা। আজ আমরা যেভাবে ওয়েব সার্চ করি সেরকম ফুল টেক্সট ওয়েব সার্চ ইঞ্জিনের সর্বপ্রথম প্রচলনকারীর শিরোপা যাবে ‘ওয়েব ক্রলার’ সার্চ ইঞ্জিনের কাছে। আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে, সেই ১৯৯৪ সালে জন্ম নিয়েছিল ওয়েব ক্রলার।
সর্বপ্রথম পডকাস্টসময়টা ২০০০-এর অক্টোবর। ব্লগিং- এর শুরুর দিকের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের একজন – ডেভিড ওয়াইনার আরএসএস ফিডের (RSS feeds) ভেতর অডিও কনটেন্টের রেফারেন্স অন্তর্ভূক্ত করার ফলে অডিও ব্লগের সিন্ডিকেশন (syndication)-এর পথ প্রশস্ত হয়। ২০০১-এর জানুয়ারি মাসে ওয়াইনার তাঁর স্ক্রিপ্টিং নিউজ ব্লগে একটি গান সংযোজনের মাধ্যমে এই নতুন আরএসএস ফাংশানালিটি প্রদর্শন করলেন। আর সাউন্ড ফাইল ডাউনলোড করে আইপড-এ শোনার যে ব্যাপার সেটি শুরু হয় ২০০৩-এর দিকে। পোর্টেবল ডিভাইসে অডিও শোনা তথা পডকাস্টিং কথাটি সর্বপ্রথম শোনা যায় ২০০৪ সালে এসে।
সর্বপ্রথম ব্লগ-জাস্টিন’স লিংক ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ডজাস্টিন হলস (Justin Halls) নামে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ওয়েবভিত্তিক ডায়েরি লিখতে শুরু করে। সালটা ছিল ১৯৯৪, আর তার সে ওয়েব ডায়েরিরনাম ছিল: জাস্টিন’স লিংক ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড (Justin’s Links from the Underground)।ওয়েব ঠিকানা: www.links.net| এতে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের এক ধরনের গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা ছিল, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে মূলত হলস-এর ব্যক্তিগত কথাবার্তাই স্থান পেতে থাকে।
নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন এ কারণে জাস্টিন হলস-কেই পারসোনাল ব্লগিং- এর প্রতিষ্ঠাতা জনক-এর স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। অবশ্য হলস যখন তার বগিং কর্মকাণ্ড শুরু করে তখনও ব্লগ কথাটির জন্ম হয়নি; হয়েছে আরো অনেক পরে। ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম জনপ্রিয়তা পায় ‘ওয়েব লগ’ কথাটি। আর তার পথ ধরে ১৯৯৯ সাল থেকে ব্যবহৃত হতে থাকে ব্লগ শব্দটি।
উইকিপেডিয়ার সর্বপ্রথম সম্পাদনাউইকিপেডিয়ায় সর্বপ্রথম সম্পাদনার কাজটি করেন উইকিপেডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস স্বয়ং। এটা ছিল একটা টেস্ট এডিট: “Hello,World!” এখন আর এটি পাওয়া যাবে না। উইকিপেডিয়ায় সবচেয়ে পুরনো যে এডিটটি পাঠক এখনও দেখতে পারেন সেটি ২০০১-এর জানুয়ারি মাসে করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তালিকায় কিছু উপাত্ত যোগ করা হয় এ এডিটের মাধ্যমে।
ইউটিউব-এর সর্বপ্রম ভিডিওইউটিউব-এ সর্বপ্রথম ভিডিও আপলোড করা হয় ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল। আপলোড করেন ইউটিউব-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত জাভেদ করিম।এ ভিডিওটির টাইটেল ছিল: মি অ্যাট দ্য জু। এতে সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানায় জাভেদ করিমের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য ছিল। এ ভিডিওটা এ পর্যন্ত ১৫ লক্ষবারের বেশি দেখেছে ইউটিউব ভক্তরা। এখনও ইউটিউবে আছে এ ভিডিওটি।
টুইটারে সর্বপ্রথম মেসেজটুইটারের সর্বপ্রম টুইট ছিল টুইটার প্রতিষ্ঠাতাত জ্যাক ডরসি-র করা একটি টুইট।তারিখ ছিল ২০০৬-এর ২১ মার্চ। টুইটটি ছিল এরকম: জাস্ট সেটিং আপ মাই টুইটার( just setting up my twttr)।এখানে যে ইংরেজি বানানে ‘টুইটার’লেখা হয়েছে সেটি আমার লেখার ত্রুটি নয়, জ্যাক ডরসি শুরুতে টুইটার এভাবেই লিখতেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই প্রচলন করেন টুইটারের বর্তমান বানান (Twitter)।
*Posted By SonaWebZone.Blogspot.Com*
0 comments:
Post a Comment